জিনজিরা প্রাসাদ

জিঞ্জিরা প্রাসাদ বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক মুঘল
স্থাপত্য যা বাংলাদেশের ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে পুরান ঢাকার ঠিক বিপরীত
ওপারে কয়েক শতগজ দূরে অবস্থিত। এটি ১৬২০ সালে নির্মাণ করা হয়। ১৬৮৯-১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সুবেদার ইব্রাহিম খান
এটি নির্মাণ করেন প্রমোদকেন্দ্র হিসেবে। প্রাসাদটি নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এর নামকরণ
হয় "কাসর-ই-জাজিরা" বা "দ্বীপের প্রাসাদ"।
নবাব সিরাজদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং তার শিশুকন্যাকে
মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে ঢাকায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সিরাজের পতনের পূর্ব
পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা ঘষেটি বেগমকে ব্যবহার করলেও সিরাজের পতনের পর আর তাকে কোনো
সুযোগই দেওয়া হয়নি।
এ সময় তারা তাদের মা সরফুন্নেসা, সিরাজের মা আমেনা,
খালা ঘষেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও তার শিশুকন্যা সবাইকে ঢাকার জিঞ্জিরা
প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়। ঢাকার বর্তমান কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা প্রাসাদে তারা বেশ
কিছুদিন বন্দী জীবন যাপন করার পর মীরনের নির্দেশে ঘষেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে নৌকায়
করে নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়। ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে শরফুন্নেসা, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা
এবং তার শিশুকন্যা রক্ষা পান এবং পরবর্তীতে তাদেরকে মুর্শিদাবাদে আনা হয়। ইংরেজ কোম্পানি
সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সামান্য বৃত্তির ওপর নির্ভর করে তাদেরকে জীবন ধারণ করতে হয়। সিরাজের
মৃত্যুর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর লুৎফুন্নেসা ১৭৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
নির্মাণশৈলী
প্রাসাদটি মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এতে ছিল
মূল প্রাসাদ ভবন, আয়তাকার সুবিস্তৃত দ্বিতল হাম্মাম, কক্ষগুলো আয়তাকার এবং ওপরে চৌচালা
খিলানাকার ছাদ ছিল। এ প্রাসাদটির নির্মাণশৈলী বড় কাটরার আদলে হলেও কক্ষ ও আয়তন অনেক
কম। দক্ষিণের সদরে প্রহরীকক্ষসহ দ্বিতল প্রবেশ ফটক এবং দুটি অষ্টকোণী পার্শ্ব বুরুজ।
পশ্চিমাংশে দু’টি সমান্তরাল গম্বুজ, মাঝ বরাবর ঢাকনাবিহীন অন্য একটি গম্বুজ
ও পূর্বাংশ দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে পুরো প্রাসাদের ছাদ। প্রাসাদের পূর্বাংশে ছাদ থেকে
একটি সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। স্খানীয়রা এ প্রাসাদকে হাবেলী নগেরা বা হাওলি নগেরা বলে।
এ প্রাসাদের তিনটি বিশেষ অংশ আজো আংশিক টিকে আছে, তাহলো প্রবেশ তোরণ, পৃথক দু’টি স্খানে দু’টি পৃথক প্রাসাদ,
একটি দেখতে ফাঁসির মঞ্চ ও অজ্ঞাত অন্যটি প্রমোদাগার। কয়েক একর জমির ওপর এ প্রাসাদ নির্মাণ
করা হয়েছিল অবকাশ যাপন ও চিত্তবিনোদনের প্রান্তনিবাস হিসেবে। চার দিকে সুনীল জলরাশির
মাঝখানে একখণ্ড দ্বীপ ভূমি জিনজিরা।
নারিকেল-সুপারি, আম-কাঁঠালসহ দেশীয় গাছগাছালির সবুজের
সমারোহে ফুলে ফুলে শোভিত অপূর্ব কারুকার্যখচিত মোগল স্খাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন জিনজিরা
প্রাসাদ। স্থানীয়দের মতে মোগল আমলে লালবাগ দুর্গের সঙ্গে জিঞ্জিরা প্রাসাদের মধ্যে
যোগাযোগ রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল। এপথে মোগল
সেনাপতি ও কর্মকর্তারা আসা-যাওয়া করত। লালবাগ দুর্গেও এমন একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে বলে
জনশ্রুতি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে এই সুড়ঙ্গ পথে যে একবার যায় সে আর ফিরে আসে না। তবে ইতিহাসে
এ সম্পর্কে জোরালোভাবে কিছু বলা নেই।
অতীত ইতিহাস
সোয়ারীঘাট সংলগ্ন বড় কাটরা প্রাসাদ বরাবর বুড়িগঙ্গা,
ওপারে জিনজিরা। জিনজিরা-জাজিরার অপভ্রংশ, যার অর্থ আইল্যান্ড বা দ্বীপ। এ দ্বীপে ১৬৮৯-১৬৯৭
খ্রিস্টাব্দে জিনজিরা প্রাসাদ ‘নওঘরা নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন সুবেদার নওয়াব ইব্রাহিম
খাঁ। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে শহর থেকে জিনজিরার মধ্যে চলাচলের জন্য একটি কাঠের পুল
ছিল। পলাশীর যুদ্ধে সর্বস্বান্ত সিরাজদ্দৌলার পরিবার পরিজনকে জরাজীর্ণ জিনজিরা প্রাসাদে
প্রেরণ করা হয়েছিল। আর সেই সাথে নবাব আলিবর্দী খাঁর দুই কন্যা, ঘসেটি বেগম ও আমেনা
বেগমকেও আনা হয়। তারা দু’জন পিতার রাজত্বকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
অবশেষে এক দিন পরিচারিকাদের সাথে একই নৌকায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সে দিন বুড়িগঙ্গার
তীরের জিনজিরা প্রাসাদে বন্দীদের নিয়ে রক্ষীদল উপস্খিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, নবাব আলিবর্দী
খাঁ ও তার পরিবার আগেই এখানে স্খান লাভ করেছিল। এভাবে পরাজিত নবাবের পরিবার-পরিজন জিনজিরা
প্রাসাদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার পর মীরজাফরের পুত্র মীরনের চক্রান্তে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের
গ্রীষ্মের কোনো এক সন্ধ্যায় সিরাজ পরিবার জিনজিরা প্রাসাদ থেকে নেমে বুড়িগঙ্গা নদীর
বুকে এক নৌকায় আরোহণ করে। নৌকা যখন বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর সঙ্গমমূলে ঢাকাকে পেছনে রেখে
এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মীরননিযুক্ত ঘাতক বাকির খান নৌকার ছিদ্রস্খান খুলে দিয়ে নৌকাটি ডুবিয়ে
দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই তলিয়ে যান বুড়িগঙ্গায়।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে জিঞ্জিরা প্রাসাদ অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।
প্রাসাদের আস্তর খসে পড়েছে, এবং চারপাশে গড়ে উঠেছে আধুনিক ভবন। স্থানীয়দের মতে, প্রাসাদটি
সংরক্ষণের জন্য কোনো সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একদা এটা ছিল নির্জন গ্রাম, যার নাম
হাওলি বা হাবেলী। বর্তমানে ঘিঞ্জি বসতি। ছোট গলিপথে একটু এগোতে একটা প্রবেশ তোরণ। তোরণের
দুই পাশে স্খায়ী ভবন নির্মাণ করে আবাস গড়ে তোলা হয়েছে। চার দিকে দোকানপাট, ঘরবাড়ি,
অট্টালিকা প্রবেশ অনেক কষ্টসাধ্য। প্রাসাদটির পূর্বাংশ তিনতলা সমান, দেখতে অনেকটা ফাঁসির
মঞ্চ বা সিঁড়িঘর বলে মনে হয়। মাঝ বরাবর প্রকাণ্ড প্রাসাদ তোরণ। মোগল স্খাপত্যের অপূর্ব
কারুকার্যখচিত তোরণ প্রাসাদকে দুই ভাগ করে অপর প্রান্তে খোলা চত্বরে মিশেছে। প্রাসাদ
তোরণের পূর্বাংশেই ছিল সুড়ঙ্গপথ। ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমল থেকে দেখে এলেও আধকার প্রকোষ্ঠে
কেউ ঢুকতে সাহস করত না এই সুড়ক পথে। পশ্চিমাংশের অর্ধকার কুঠরি ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ
অব্যবহৃত। এ প্রাসাদটির নির্মাণশৈলী বড়কাটরার আদলে হলেও কক্ষ ও আয়তন অনেক কম। ২০১৮
সালে সরকার এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
সর্বশেষ মালিকানা
পুরো প্রাসাদ
ও এর আশপাশ মালিকি ও তত্ত্বাবধায়ক পরিবারের পূর্বপুরুষ হাজী অজিউল্যাহ ব্রিটিশ আমলে
১৪ শতক জমি সাফ কবলা মূলে খরিদসূত্রে মালিক। ওয়ারিশসূত্রে বর্তমান মালিক ও পরিবার প্রধান
জাহানারা বেগম (জাহারা) হাজী অজিউল্যাহ তার শ্বশুর। ইতিহাসবিদদের চোখে জিনজিরা প্রাসাদ
প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক জেমস টেইলর তার ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা গ্রন্থে নবাব ইব্রাহিম খাঁকে
জিঞ্জিরা প্রাসাদের নির্মাতা বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদঅধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন বলেন,
জিঞ্জিরা প্রাসাদের সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের এক বিষাদময় স্মৃতি জড়িত।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার মা, স্ত্রী ও শিশু কন্যা এক সময় এই জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি ছিলেন।
উমি চাঁদ, জগত শেঠ এবং রায় দুর্লভদের পরামর্শে প্রাসাদ থেকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাবার
ছল করে নওয়াজিস মহীয়সী ঘসেটি বেগম, নবাব সিরাজের মা আমিনা বেগম, নওয়াজিসের উত্তরাধিকারী
একরাম উদ্দৌলার শিশুপুত্র মুরাদউদ্দৌলা, নবাব বেগম এবং শিশু কন্যাকে ধলেশ্বরীর বুকে
৭০ জন অনুচরসহ ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। হুসেন কুলি ও সরফরাজের বংশধরগণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির
কাছে দেওয়ানী ভার অর্পণ করার পর বন্দিদশায় জিঞ্জিরা প্রাসাদেই অবস্থান করছিলেন। ইতিহাসবিদ
নাজির হোসেনের কিংবদন্তি ঢাকা গ্রন্থে বলা হয়, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারকে দীর্ঘ ৮
বছর জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়। মোগল শাসকদের অনেককে এই দুর্গে নির্বাসন
দেয়া হয়েছিল।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
জিঞ্জিরা
প্রাসাদ বাংলার ইতিহাসে একটি বিষাদময় অধ্যায়ের সাক্ষী। পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) পর,
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর তার মা আমেনা বেগম, স্ত্রী লুৎফুন্নেছা বেগম, কন্যা উম্মে
জোহরা, খালা ঘসেটি বেগম এবং দাদি শরফুন্নেছাকে এই প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়। পরবর্তীতে,
মীর জাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা নদীতে
ডুবিয়ে হত্যা করা হয় ।
পরিদর্শন নির্দেশনা
জিঞ্জিরা প্রাসাদ পরিদর্শন করতে চাইলে ঢাকার গুলিস্তান থেকে সদরঘাট এসে বুড়িগঙ্গা নদী পার হতে হবে। সোয়ারিঘাট সংলগ্ন বড় কাটরা প্রাসাদ বরাবর বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরা ঘাট। সেখান থেকে হাঁটাপথেই প্রাসাদে পৌঁছানো যায়। জিঞ্জিরা প্রাসাদ বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, যা আমাদের অতীতের গৌরবময় ও বেদনাদায়ক অধ্যায়ের স্মৃতি বহন করে।