সংবাদ শিরোনাম

আম গাছ চাষ পদ্ধতি ও এর উপকারিতা

 প্রকাশ: ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:১১ অপরাহ্ন   |   কৃষি

আম গাছ চাষ পদ্ধতি ও এর উপকারিতা

বাংলাদেশের জাতীয় ফল আম। এটি শুধু একটি সুস্বাদু ফলই নয়, বরং আমাদের অর্থনীতি, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য–সব দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আম গাছ চাষ বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং লাভজনক কৃষিকর্ম। এই লেখায় আম গাছ চাষের গুরুত্ব, উপকারিতা এবং নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

 আম গাছ চাষ: আম গাছ (Mangifera indica) সাধারণত ১০–১৫ মিটার লম্বা হয় এবং এটি একটি দীর্ঘজীবী বৃক্ষ। উপযুক্ত যত্ন নিলে এক গাছ বহু বছর ধরে ফল দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের মাটির গুণমান ও আবহাওয়া আম গাছ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া অঞ্চলগুলো আম উৎপাদনে বিখ্যাত।


 আম গাছ চাষের উপকারিতা

আম গাছের উপকারিতা অনেক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। নিচে পর্যায়ক্রমে তা তুলে ধরা হলো।

১.  অর্থনৈতিক উপকারিতা

 ক. কৃষকের আয় বৃদ্ধি:আম গাছ থেকে উৎপন্ন ফল বিক্রি করে কৃষকরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় করতে পারে। এক একটি পরিপক্ব গাছে বছরে ২০০–৩০০ কেজি পর্যন্ত আম পাওয়া যায়, যা বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়।

 খ. রপ্তানি বাজার:বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। যেমন: মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলা হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি জাতের আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

 গ. কর্মসংস্থান সৃষ্টি:আম চাষ, সংগ্রহ, প্যাকেজিং, রপ্তানি, ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।

২.  পরিবেশগত উপকারিতা

 ক. অক্সিজেন উৎপাদন:একটি পূর্ণবয়স্ক আম গাছ বছরে প্রায় ১২০ কেজি অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে। এটি বাতাস বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে।

 খ. কার্বন শোষণ:আম গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশে কার্বন হ্রাস করে, যা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সহায়ক।

 গ. মাটি সংরক্ষণ:গাছের শিকড় মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং মাটির উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে।

 ঘ. বৃষ্টিপাত ও জলচক্রে ভূমিকা:বৃক্ষ থাকলে মেঘ সঞ্চার ও বৃষ্টিপাত বেশি হয়। এটি এলাকার মাইক্রোক্লাইমেট উন্নয়নে সহায়ক।

৩. স্বাস্থ্য উপকারিতা

ক. ফল হিসেবে আমের পুষ্টিগুণ:আম একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল।  । এতে রয়েছে— ভিটামিন A, C, E; আঁশ; পটাশিয়াম; ম্যাগনেশিয়াম এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ,এগুলো দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, হজমে সহায়ক এবং ত্বক উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে।

 খ. আম পাতার ওষুধি গুণ:আম গাছের পাতা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা এবং হজমে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথিতে আমপাতার ব্যবহার বহুল প্রচলিত।

 গ. আমের আঁটির উপকারিতা:আমের আঁটি শুকিয়ে গুঁড়ো করে বদহজম, ডায়রিয়া ও ত্বকের রোগে ব্যবহার করা হয়।

৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপকারিতা

 ক. ছায়াদান ও পরিবেশ শীতল রাখা:আম গাছ তার ছায়ায় আশপাশের পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। গ্রামের বাড়ির উঠানে বা রাস্তার পাশে আম গাছ থাকলে সেখানে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ হয়।

 খ. পারিবারিক সম্প্রীতির প্রতীক:আম গাছ ঘিরে পারিবারিকভাবে বিভিন্ন উৎসব, পিকনিক, আম ভোজন বা মিলনমেলার আয়োজন হয়। এটি পরিবার ও প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করে।

৫. বিভিন্ন জাত ও তাদের বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের আম চাষ হয়। কিছু উল্লেখযোগ্য জাত হলো:হিমসাগর সুস্বাদু, আঁশবিহীন,রসালোরাজশাহী,চাঁপাইনবাবগঞ্জ ,ল্যাংড়া মাঝারি সাইজ, সুগন্ধিযুক্ত দিনাজপুর, রাজশাহী আম্রপালি ছোট আকৃতি, বেশি মিষ্টি যশোর, সাতক্ষীরা গোপালভোগ টক-মিষ্টি স্বাদ রাজশাহী ফজলি বড় আকৃতির, বেশি রস রাজশাহী, নাটোর বিভিন্ন জাতের কারণে চাষি তার বাজার অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আম চাষের কিছু টিপস (সংক্ষেপে)মাটি: দোআঁশ বা পলিমাটি সবচেয়ে ভালো ,চারা অবস্থায় নিয়মিত পানি দিতে হয়। জৈব সার যেমন গোবর, পচা পাতা; এছাড়া ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশ

কীটনাশক: ফল ছিদ্রকারী পোকা, পাতামোড়ানো পোকার হাত থেকে রক্ষা প্রয়োজন   । গাছকে স্বাস্থ্যবান ও ফলবান রাখতে প্রতিবছর গাছ ছাঁটাই জরুরি

 চাষ থেকে লাভবান হওয়ার কৌশল: 1. উন্নত জাত নির্বাচন করুন। 2. বাগানভিত্তিক উৎপাদনে যান। 3. প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করুন (যেমন: আমচুর, আমসত্ত্ব, আমের আচার) ।4. সরাসরি বাজারজাতকরণ বা অনলাইন বিক্রির ব্যবস্থা করুন ।5. রপ্তানি মান বজায় রেখে উৎপাদন করুন



 সতর্কতা 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাঝে মাঝে ফলন কমে যায়। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার আমের গুণমান নষ্ট করে। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকদের লাভের অংশ কমিয়ে দেয়।

তবে আধুনিক প্রযুক্তি ও সরকারিভাবে সহায়তা পেলে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। আম গাছ চাষ বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং পুষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এটি শুধুমাত্র একটি ফলের গাছ নয়—বরং এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক বন্ধনের একটি অন্যতম উৎস।

যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে, যত্ন সহকারে আম চাষ করা যায়, তাহলে এটি হতে পারে একটি টেকসই এবং লাভজনক কৃষি উদ্যোগ। ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য খাদ্য, পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আম গাছ চাষ বাড়ানো সময়ের দাবি।