সংবাদ শিরোনাম

বাল্যবিবাহ রোধে কিশোরীর জাগরণ: ব্র্যাকের উদ্যোগে নতুন সম্ভাবনা

 প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৩১ অপরাহ্ন   |   সম্পাদকীয়

বাল্যবিবাহ রোধে কিশোরীর জাগরণ: ব্র্যাকের উদ্যোগে নতুন সম্ভাবনা

নুরুল আশেকিন (ইয়াশ)

বাংলাদেশে এখনো বাল্যবিবাহ একটি গভীর সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। নানা প্রচার, আইন ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও দেশের বহু অঞ্চলে আজও মেয়েরা অল্প বয়সেই সংসারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হচ্ছে। ইউনিসেফের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৫১% নারী ১৮ বছরের আগে এবং প্রায় ১৫% নারী ১৫ বছরের আগেই বিবাহিত হন যা বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ হার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে এখনো শীর্ষ তিনের মধ্যে রয়েছে।

কারণ ও পরিণতি

বাল্যবিবাহের পেছনে দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার, নিরাপত্তা আশঙ্কা এবং শিক্ষার অভাবই সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এর ফলাফল ভয়াবহ। অল্প বয়সে বিবাহিত মেয়েরা প্রায়ই প্রজননজনিত স্বাস্থ্য জটিলতা, মানসিক আঘাত, শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়া এবং পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। একদিকে যেমন তারা নিজেদের স্বপ্ন হারান, অন্যদিকে সমাজ হারায় এক সম্ভাবনাময় নারী শক্তিকে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) ও ব্র্যাকসহ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়যেসব কিশোরী ১৮ বছরের আগে বিবাহিত হয়, তাদের উচ্চশিক্ষা ও কর্মজীবনে অংশগ্রহণের হার প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। এর ফলে নারীশিক্ষা ও নারী শ্রমশক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে শ্লথ করে।

ব্র্যাকের উদ্যোগ: পরিবর্তনের পথে কিশোরী

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও কিশোরীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ব্র্যাক ২০২১ সাল থেকে বাস্তবায়ন করছে “সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি” (Social Empowerment and Legal Protection Program)। বর্তমানে এটি ৩৩টি জেলার ২৬৮টি উপজেলায় পরিচালিত হচ্ছে।

এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি উপজেলায় ২৫০ জন কিশোরীকে হাউজহোল্ড সার্ভের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়েছে। অর্থাৎ, সারাদেশে প্রায় ৬৭,০০০ কিশোরীকে অন্তর্ভুক্ত করে এই বৃহৎ উদ্যোগ চলছে। নির্বাচিত ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরীদের জন্য ২ বছর মেয়াদি জীবনমুখী প্রশিক্ষণ (life skills-based training) দেয়া হচ্ছে, যেখানে তাদের আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্বগুণ, সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও আইনি জ্ঞান বাড়ানোর ওপর যখন কোনো কিশোরী ১৮ বছর পূর্ণ করে, তখন স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাকে “গ্র্যাজুয়েশন সার্টিফিকেট” প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও দরিদ্র কিন্তু মেধাবী কিশোরীদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা কার্যক্রম চালু রয়েছে, যাতে তারা উচ্চশিক্ষা বা স্বনির্ভর জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারে।

ব্র্যাকের এই কর্মসূচি শুধু প্রশিক্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়; স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে লিংকেজ তৈরি করে গ্র্যাজুয়েট কিশোরীদের জন্য সুযোগ ও অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগও নিচ্ছে সংস্থাটি।

ভবিষ্যতের আশার আলো

এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো আজ পরিবর্তনের বীজ বপন করছে। যখন একজন কিশোরী নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, শিক্ষায় ও জীবনে এগিয়ে যায়তখন কেবল তার জীবনই নয়, গোটা সমাজ আলোকিত হয়।

ব্র্যাকের বিশ্বাস, এভাবে যদি প্রতিটি উপজেলায় এমন কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে, তবে একদিন বাল্যবিবাহের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এই কিশোরীরা একদিন দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে আলো ছড়াবে, নেতৃত্ব দেবে, আর নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয় অগ্রগতিকে বেগবান করবে।